শিরোনাম – উৎসারিত আলো
কবি মহুয়া মিত্র
সেই থেকে ইনিয়ে বিনিয়ে কেঁদেই চলেছে পুতুল। বিরক্তি থেকে রাগ হয়ে এবার রঞ্জনের ধৈর্য্য সহ্যের সীমা অতিক্রম করতে ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দিল মেয়ের গালে।মূহুর্তকাল চুপ থেকে ফের দ্বিগুণ চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে পালালো পুতুল। রঞ্জন অসহায়ের মতো একবার সেদিকে তাকিয়ে নিজের পায়ের দিকে চাইলো।ঘরে ঢুকলো মেনকা, –“কি ব্যাপার, মেয়েকে মেরেছো কেন?কতবার জানতে চাইলাম,কিছু না বলে পুকুরে ঝাঁপালো। এই অবেলায় পুকুরে নামল,জ্বরে না পড়ে মেয়েটা!”
রঞ্জনও চুপ করে আছে দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আলনা থেকে কাপড় নিয়ে মেনকা বলল, –” আমার হয়েছে যত জ্বালা। দাঁড়াও,পুকুরে ডুব দিয়ে পুতুলকে নিয়ে আসছি। তারপর ভাত দেব।”
–“আমি অকেজো বাবা,মেয়ের আবদার না মিটিয়ে গায়ে হাত তুললাম!ভগবান আমাকে ক্ষমা করবেন না,দেখো।”বলে নিজের দুই হাঁটু অবধি পা জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ল রঞ্জন।মেনকাও চোখে আঁচল দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।কেউ খেয়াল করল না পাশের জানলার আড়ালে লুকিয়ে সবটুকু দেখল শিবেন।
গ্ৰামের একদম শেষ প্রান্তে নগেন পালের বাড়ি। অবশ্য একে বাড়ি না বলে ঝুপড়ি বলাই ভালো। একা বৃদ্ধের বেঁচে থাকতে যা লাগে,তার থেকেও কম পরিসরে জীবনযাপন নগেনের।সারা দিন মাটির সঙ্গে কাটে তার।হাঁড়ি-কলসি থেকে শুরু করে থালা-গ্লাস এমনকি লক্ষ্মী-সরস্বতী হয়ে গ্ৰামের একমাত্র দুর্গা প্রতিমাও সেই গড়ে।না আছে গ্ৰামবাসীদের চাহিদা, না আছে নগেনের চাহিদা। দিব্যি চলছে।
সন্ধ্যের অন্ধকারে শিবেন এসে ঢুকলো নগেনের ঘরে, –“নগেন জ্যাঠা!”
প্রায়ান্ধকার ঘর থেকে উত্তর এলো, –“কে, শিবেন না কি?আয়।”
শিবেন ঘরে ঢুকে দেখল নগেন একটা প্রদীপ জ্বেলে গামছা ঘুরিয়ে বাতাস করছে।ওকে দেখে বললে, –” ভাদ্দুরে পচা গরম।তা তোর মুখখানি অমন কেন বাবা?”
–“আমার টাকা দরকার জ্যাঠা।”বলে শিবেন মেজেতে করুণ মুখে বসল।
–“হাসালি বাপ। আমি কোথায় টাকা পাবো!”
–” না জ্যাঠা, তোমার কাছে চাইছি না। আমি তোমার কাছে মাটির কাজ শিখতে চাই। সেসব বিক্রি করে টাকা উপার্জন করব। পুতুল আজ বাবার কাছে মার খেয়েছে নতুন জামা আবদার করে। আমি দাদা হয়ে বোনের কষ্ট সহ্য করতে পারছি না জ্যাঠা।”
নগেন হাত রাখল শিবেনের মাথায়। কতই বা বয়স, চোদ্দ কি পনেরো। অথচ কি দায়িত্ব বোধ! উপার্জন করে বোনের শখ মেটাতে চায়। কিন্তু পরিস্থিতি ওর পড়াশোনাটাও বন্ধ করে দিল!
ষ্টেশন চত্বরে ভ্যান টেনে পেটের ভাত আর ছেলেমেয়ের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে কোনো অসুবিধা হচ্ছিল না রঞ্জনের। কিন্তু ঐ অ্যাক্সিডেন্টে ওর দুই পা বাদ যেতে পুরো পরিবারটাই স্তব্ধ হয়ে গেছে। মেনকা দূর শহরে রান্নার কাজ করে এক মুঠো ভাতের ব্যবস্থা করলেও ছেলেমেয়েদের শখ তো দূরের কথা, পড়াশোনাও বন্ধ করতে বাধ্য হয়।
–” বললেই কি শেখা যায় শিবেন। সময় লাগবে, ধৈর্য্য লাগবে। আর পয়সা উপার্জন তো সহজ কথা নয়।”
ঘরের চারদিকে ভালো করে চোখ বুলিয়ে নিল শিবেন। তারপর বেশ উত্তেজিত হয়ে বলল, –” জ্যাঠা!” শিবেনের চোখে মুখে হাজার আলোর ঝলকানি। –” মাটির প্রদীপ! হ্যাঁ জ্যাঠা, মাটির প্রদীপ। তুমি আমাকে প্রদীপ তৈরি করা শিখিয়ে দাও। ও তো ছোট জিনিস, আমি শিখে নেব। তারপর শহর চত্বরে বিক্রি করব। সামনে উৎসবের সময় আসছে। তখন নয় পুতুলকে নতুন জামা কিনে দেব। শেখাবে তো জ্যাঠা?”
আলগোছে চোখ মুছে নগেন বললে, –” নিশ্চয়ই শেখাবো। ইস, সব্বাই যদি এভাবে ভাবত, কি ভালোই না হতো। বেঁচে থাক বাবা, আশীর্বাদ করি। তোরা আছিস বলেই এই পৃথিবীটা পুরো কলুষিত হয় নি। লেখাপড়াই সব নয়। মনের সৎ ইচ্ছেও মানুষকে এগোতে সাহায্য করে। তুই তার উদাহরণ।”
কাছাকাছি কোথাও সন্ধ্যারতির শঙ্খ-ঘন্টা বেজে উঠলো। শিবেনও চোখে একরাশ স্বপ্নের জাল বুনতে বুনতে বাড়ির পথ ধরল।