ছোট গল্প
শিরোনাম: বকুল -প্রিয়া
লেখিকা: শ্রাবনী মজুমদার
তারিখ: ১৬/১১/২৪
বকুল তলে মিষ্টি সুবাস নিত্য প্রভাত বেলা- পুকুর ধারে বকুল প্রিয়ার পুতুল পুতুল খেলা। লাল শাড়িতে নূপুর বাজে রিনিঝিনি পায়। গাঁয়ের পথে হেলেদুলে বকুল-প্রিয়া যায়। এই জুটিটা হঠাৎ করে ভাঙ্গার শব্দে মনটা কেমন করে। বকুল কাঁদে প্রিয়ার জন্য একলা নিশি ভরে।
বকুল প্রিয়ার মিষ্টি মধুর শৈশব দুরন্তপনায় হঠাৎ মেঘ ভাঙ্গা গর্জন। বকুলকে শহরে পড়াশুনার উদ্দেশ্য যেতেই হবে বাবার হুকুম। বিচ্ছেদের সম্ভাবনায় ব্যাথিত বকুল।অব্যক্ত ক্রন্দন অন্তর্যামী ছাড়া কেউ শুনতে পায়না। বকুলের একটা চিঠি প্রিয়ার উদ্দেশ্যে,” তুই দেখিস আমি একদিন তোর কাছে ফিরে আসব” চিঠির সাথে গাঁয়ের মেলা থেকে কেনা একটা “হ্যালো” কথা বলা পুতুল উপহার পাঠিয়ে বকুল বিদায় নিল ।
পিতৃহারা ছোট্ট প্রিয়া কেঁদে কেঁদে শয্যাশায়ী, শৈশবের সাথীকে হারিয়ে খাওয়া দাওয়া কিছুদিন বন্ধ, জ্বরে কাতরাচ্ছে। এমনি ভাবে কিছু দিন কাটে, পাঠশালায় পড়ায় মন বসে না। প্রিয়ার মা এরই মধ্যে অসুস্থ হয়ে পরলোক গমন করেছেন। প্রিয়াকে তার মামা এসে নিয়ে যায়। সেখানে তার মামাতো বোন রেখার সাথে অনেক আদরে মামা লালন পালন করার চেষ্টা করে। কিন্তু প্রিয়ার ভেতরের চাপা কষ্ট সমস্ত আদরের কাছে তুচ্ছ হয়ে পড়ে থাকে। আস্তে আস্তে মন থেকে শৈশব স্মৃতি ঝাপসা হয়ে উঠছে ভেবে প্রিয়া রোজ সেই পুতুলের সাথে কথা বলতে থাকে। বকুল স্মৃতির পাতায় স্মৃতি হয়ে থাকুক সে চায় না। তাকে সজীব জীবন্ত রাখতেই এই কথা বলা। যেন সেই কথা বলা পুতুলটা তার একমাত্র সঙ্গী তার প্রিয় বকুল।
ভেতরের চাপা কষ্ট বাকি সবার কাছে থেকে তাকে আলাদা করে দিচ্ছে। দিন দিন প্রিয়া যেন বোবার মত নির্বাক হয়ে যাচ্ছে। কানে শুধু একটা কথাই বাজে” তুই দেখিস আমি একদিন তোর কাছে ফিরে আসব।” মামির নির্দেশে ঘরের সমস্ত কাজ নিঃশব্দে করে যাচ্ছে মুখে কোন কথা নেই। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে, ইচ্ছে হলে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। যেন নিস্তব পাতালপুরীর একমাত্র রাজকন্যা। কুয়াশা ঢাকা প্রভাতের মত সমস্ত হৃদয় অশ্রু বাষ্পে মর্মবিদ্ধ।
এদিকে রেখা পড়াশুনায় খুব ভালো। স্কুল পাস করে শহরের কলেজে ভর্তি হয়েছে। একই কলেজে বকুলও ভর্তি হয়েছে। আস্তে আস্তে দুজনের মধ্যে পরিচয় হয় এবং বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। আস্তে আস্তে প্রেম ভালোলাগা বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে দুজনের মধ্যে। আর প্রিয়ার ঝাঁপসা হৃদয়ে সুদীর্ঘ পল্লব বিশিষ্ট বড় বড় দুটো চোখের কোণে একফোঁটা জলে বকুলের মুখটা আজো ভেসে ওঠে। কথা বলা পুতুলটার মধ্যে বকুলের স্মৃতি খুঁজে ফেরা তার নিত্য অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
বাবা মায়ের সাথে পরিচয় করাতে বকুলকে রেখা তাদের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসে। হঠাৎ করেই বকুল প্রিয়ার মুখমুখি কিন্তু কেউ কাউকে চিনতে পারে না। প্রিয়ার বড় বড় মায়া ভরা চোখ দুটো বকুলকে গুরুত্বর ভাবে টানে কিন্তু কেন সেটা বকুল বুঝতে পারে না।
প্রিয়া তার মামার কাছ থেকে বকুলের পরিচয় জানতে পেরে চমকে ওঠে দৌড়ে তার কাছে ছুটে যায় কিন্তু যখন দেখতে পায় সে রেখার সাথে প্রেমে মগ্ন তখন এক বুক কষ্ট নিয়ে নিজের পরিচয় লুকিয়ে রাখে। রেখার মুখে নিশ্চিন্ত আনন্দ দেখে অন্তরে অন্তরে প্রিয়ার হৃদয় বিদীর্ণ হতে থাকে।
দু-একটি দিন পরে প্রিয়ার প্রচণ্ড জ্বর আসে। কিছুতেই জ্বর কমছে না গ্রামের ডাক্তারের পরামর্শ তাকে সদর হাসপাতালে ভর্তি করানো। সেই মোতাবেক প্রিয়ার মামা আর বকুল দুজনে মিলে প্রিয়াকে নিয়ে সদর হাসপাতালে ভর্তি করে। হাসপাতালের বেডে মাঝরাতে প্রিয়া জ্বরে অচেতন হয়ে বলে উঠে “তোমার প্রিয়াকে ভুলে গেলে বকুল” বকুল এটা শুনে চমকে উঠে! তার কানে বেজে ওঠে সেই প্রতিজ্ঞা “তুই দেখিস একদিন আমি তোর কাছে ফিরে আসব” চোখের সামনে ভেসে ওঠে বকুল প্রিয়ার শৈশব স্মৃতি। বকুল পাগলের মত কাঁদতে থাকে।
ভোর হতে না হতেই সে ছুটে যায় প্রিয়ার মামার কাছে প্রিয়ার পরিচয় জানতে। সবকিছু শুনে সে বুঝতে পারে এটা তার শৈশবের বকুল। পরে প্রিয়ার ঘরে গিয়ে সেই পুতুল এবং চিঠি খুঁজে পায়। রেখার কাছে বকুল ক্ষমা চেয়ে বলে, “রেখা তোমার আর আমার মধ্যে যে সম্পর্ক ছিল সেটা ভালো লাগা ভালোবাসা নয়।” ভালোবাসা অন্তর গেঁথে থাকে হয়তো কিছু সময় উপরে আস্তরণ জমা পড়ে কিন্তু বিলীন হয় না। রেখা সবকিছু জেনে সহজ ভাবে বিষয়টা মেনে নেয়। বকুল প্রিয়ার কাছে ক্ষমা চেয়ে বলে সে তার দেয়া কথা রাখতে পারে নি এটা তার জীবনের মস্তবড় একটা ভুল। এই ভুলের এখানেই ইতি টানবে বকুল।
এখন পাকাপোক্ত ভাবে কেউ যাতে তাদের আলাদা করতে না পারে সে জন্য হসপিটাল থেকে ফিরেই তারা মামার আশীর্বাদ নিয়ে বিয়ে করে গ্রামের বাড়িতে ফিরল। বকুলকে বাবা সহজে মেনে না নিলেও বকুলকে ও প্রিয়াকে মা অনেক যত্নে বরণ করে নিল । অবশেষে আস্তে আস্তে বাবাও মেনে নিল। বিচ্ছেদের পরে আবার সুখের দোরগোড়ায় “বকুল -প্রিয়ার” জীবন।