শিরোনাম:স্মৃতিহীন
কবি:সুমাইয়া ইসলাম স্নেহা
নওগাঁ বাংলাদেশ।
রুমটা একেবারে সাদা। দেয়ালে কোনো ছবি নেই, জানালার পাশে কাচঘেরা একটা টেবিল। তার ওপর ছোট একটা যন্ত্র, যেটা দেখতে অনেকটা আধুনিক হেডফোনের মতো—তবে তার ক্ষমতা অনেক বেশি।
আনন্যা চুপচাপ বসে আছে। তার চোখদুটো লাল, কাঁদা বন্ধ হয়েছে অনেকক্ষণ আগে। আজ তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন। না, কোনো উৎসব নয়, বরং—স্মৃতি মোছার দিন।
“আপনি নিশ্চিত তো, মিস আনন্যা?”
ডাঃ রায় শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন। তার কণ্ঠে না ছিল তাড়াহুড়ো, না সহানুভূতি—যেমন হওয়া উচিত একজন স্মৃতি-মোছার পেশাদারের।
আনন্যা মাথা নাড়ল।
“হ্যাঁ। আমি আর ওর কথা মনে রাখতে চাই না।”
ও, মানে—আর্যন।
তার চোখে এখনো মাঝে মাঝে ভেসে ওঠে ছেলেটার হাসিমুখ, আঙুলের ছোঁয়া, আর সেই প্রথম দেখা। কিন্তু সেই মানুষটাই এখন হারিয়ে গেছে। কেবল শরীর বা অবস্থান নয়—সে হারিয়েছে আস্থা, কথা, আর ভালোবাসা।
“আমাদের নিয়ম অনুযায়ী, একবার মোছা হলে আপনি আর ফিরিয়ে আনতে পারবেন না।”
“আমি জানি,” সে নিঃশব্দে বলল।
ডাঃ রায় যন্ত্রটি আনন্যার কপালের ওপরে স্থাপন করলেন। চোখ বন্ধ করতেই আনন্যার মনে পড়ে গেল শেষবার আর্যনের সাথে ঝগড়া, ভাঙন, নিরবতা। তারপরও তার মন বলছিল—এই সিদ্ধান্ত কি ঠিক?
যন্ত্রটি চালু হলো। একঝলক নীল আলো ছড়িয়ে পড়ল ঘরে।
তখনই, ঠিক সেই মুহূর্তে, তার মনে প্রশ্ন উঠল—
“যদি স্মৃতি মোছা যায়, তবে হৃদয়ের শূন্যতা কে মোছাবে?”
একটা ঠাণ্ডা অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল শরীরজুড়ে। যেন স্মৃতির সাথেই মনটাও একটু একটু করে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।
যখন যন্ত্রটি বন্ধ হলো, ডাঃ রায় বললেন, “শেষ। এখন আপনি সম্পূর্ণ নতুন একজন।”
আনন্যা চোখ খুলল। তার চোখে আর্যনের কোনো চিহ্ন নেই। মুখ ফ্যাকাশে, কিন্তু শান্ত। সে উঠে দাঁড়াল, ধীরে ধীরে রুমের বাইরে পা রাখল।
কিন্তু ঠিক দরজার সামনে এসে হঠাৎ থমকে গেল।
তার বুকের বাঁদিকে কেমন একটা কষ্ট, ব্যাখ্যাতীত এক টান।
সে জানে না, কাকে খুঁজছে, কেন এই ব্যথা।
শুধু জানে—কিছু একটা ছিল, অনেক গভীর।
এখন নেই।
তবু অনুভবটা থেকে গেছে।
অনেক সময় পরে, আনন্যা শহরের পথে হাঁটতে হাঁটতে আর্যনের কথা মনে করল। ততদিনে সে জানে—স্মৃতির একেকটি অংশ হারিয়ে যেতে পারে, কিন্তু ভালোবাসার অনুভূতি মুছে ফেলা যায় না।
তবে, সে কি কখনো জানবে, এই যন্ত্রের মাধ্যমে যে খালি জায়গাটা তৈরি হল, তা কোনো প্রযুক্তি পূর্ণ করতে পারবে? স্মৃতি তো কোথাও থেকে উঠে আসে—জীবনের একটা অংশ তো।
যখন তার চোখে পানি এসে পড়ল, সে বুঝতে পারল—ভালোবাসা শুধু মস্তিষ্কে জমা থাকে না, তা হৃদয়ের গভীরে, অক্ষয় হয়ে রয়ে যায়।
কবি ও কথাসাহিত্যিক
শিক্ষার্থী
নওগাঁ সরকারি কলেজ, নওগাঁ।