ছোট গল্প। গল্পের শিরোনাম – স্রষ্টা
কলমে — মহুয়া মিত্র ।
চোখটা লেগে এসেছিল মাণিকের। আচমকা মেঘের ডাকে ধরমরিয়ে উঠে ছুট লাগালো পিছনের উঠোনে। চৈত্র পড়তে না পড়তেই জব্বর গরম দিয়েছে। তাই তো দুপুরে খেসারি ডালের বড়া দিয়ে দু গ্ৰাস পান্তা বেশি খাওয়া হয়ে গেছিল। শরীর জুড়ে আলস্য। আর হবেই বা না কেন, কাজের চাপ বেড়ে গেছে যে! সামনে নীল, চড়ক, গাজন। কত সব মেলা বসবে। কত দূর দূর সেই মেলায় পৌঁছাবে মাণিকের হাতের মাটির কাজ। এই তল্লাটে মাণিক পালের মতো গুণী মৃৎশিল্পী আর দুটো নেই।
তাই চৈত্র পড়তে নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই ওর। সকালের তৈরি জিনিসপত্রগুলো দুপুরে গনগনে রোদে শুকাতে দিয়ে বিশ্রাম নিতে গেছিল। যা মেঘ করেছে কালবৈশাখী এলো বলে! সব এক্ষুনি ঘরে ঢোকাতে হবে। দ্রুত হাতে সব ঘরে তুলছিল, হঠাৎ মেজাজ চড়ে গেল। কোন মতে সব নিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে চেঁচিয়ে উঠলো, –” অপু।” বাইরে তখন ঝড় উঠেছে।
মাণিকের গলা শুনে জড়সড় হয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো অপু, ওর দশ বছরের ছেলে অপরেশ।
–” আজ চারটে হাতি শুকোতে দেওয়া ছিল, এখন তিনটে আছে। আরেকটা তুই নিয়েছিস?”
অপু চুপ।
–” চুপ করে দাঁড়িয়ে লাভ নেই। নিলে দিয়ে দে। ঐ হাতি থেকে কুড়ি টাকা লাভ হয়।”
অপু তাও চুপ।
–” আগেও খেলনা সরিয়েছিস, কিছু বলি নি। এগুলো সব মেলার অর্ডার। দিয়ে দে অপু।”
মাণিক এসে ছেলের কাঁধে হাত রেখে বলল, –” আমার এত সুনাম, এত মাটির জিনিস বেচি, তবু কয় টাকা পাই বল্! সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয় দশা। খাটনির জিনিস বাপ সরাস না, দিয়ে দে। অবসরে ঐ হাতি পুতুল তোকে গড়ে দেব।”
পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো সুমি,অপুর আট বছরের বোন, –” ওটা তো দাদা বল খেলতে গিয়ে ভেঙে ফেলেছে, আমি দেখেছি বাবা।”
–” কতবার বলেছি যখন মাটির জিনিস শুকোতে দেব তখন বল খেলবি না।”
ঝড় থেমে গেছে অনেক আগেই। আকাশে তারা ফুটেছে কিন্তু ঘরে তখনও গুমরোচ্ছে অপু। নীলা ছেলের গায়ের কালশিটেগুলোয় ভেজা কাপড় বুলোতে বুলোতে বলল, –” তোকেও বলিহারি যাই অপু, জানিস তো তোর বাপ রাগলে চন্ডাল।এত অর্ডার আসছে, মানুষটার নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই। আর তুই দেখে খেলবি না? দেখো দেখি, কত বাজে ভাবে তোর গায়ে হাত তুলেছে!”
সারা শরীরে অসহ্য ব্যথা আর হালকা উত্তাপ নিয়ে না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে অপু। ছেলের গায়ে চাদর টেনে নিজেও ঘুমিয়ে গেছে মাণিক। সুমিকে খাইয়ে আর দেরি না করে নীলাও মেঝেতে বিছানা করে মেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়লো। স্বামী সন্তান অভুক্ত, সে বেচারিই বা খায় কি করে!
হঠাৎ মাঝরাতে কিসের ধাক্কা লেগে ঘুম ভাঙল নীলার। দেখে অন্ধকারে ওকে ডাকছে মাণিক। চুপ থাকার ইঙ্গিত করে পিছন পিছন আসার ইশারা করলো। নীলা ওকে অনুসরণ করে মাটির কাজের ঘরে গিয়ে অবাক। এই রাতে অন্ধকারে কুপি জ্বালিয়ে অপু চুপি চুপি একটা হাতি বানিয়েছে, অবিকল মাণিকের তৈরি হাতির মতো।
আলতো করে চোখের জল মুছে ছেলের পাশে বসে মাণিক বলল, –” তুই তো এই কাজ কখনও শিখিস নি রে অপু, বানালি কি করে?”
নীলা বললো, –” সব কিছু কি শিখতে লাগে গো? ওর রক্তে মিশে আছে শিল্পের জাত। তাই করেছে। তুমি যেন ওকে আর বকাবকি কোরো না।”
–” সত্যি, তখন এমন মাথা গরম হয়ে গেল, নিজেকে আটকাতে পারলাম না। খুব লেগেছে না অপু?” ছেলের গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে বলল মাণিক।
–” এই হাতিটা মেলায় দেবে তো বাবা?” বলল অপু।
–” দেব দেব নিশ্চয়ই দেব। এমন সুন্দর জিনিষ না দিলে হয়!”
–” আমার অপু একদিন তোমার থেকেও বড়ো শিল্পী হবে দেখো।”
নীলার কথার উত্তরে মাণিক বলল, –” সে তো আমিও চাই কিন্তু শিল্পের কদর যে কমছে, মাটির এই পুরনো শিল্পের কদর এখন খুব কম। কত কিছু বাজারে এসেছে, কত ঝকঝকে সে সব। এগুলো এখন কেউ নিতে চায় না নীলা।”
–” সে তুমি যাই বলো, সেই জ্ঞান ইস্তক শুনছি মাটির কাজ বাংলার ঐতিহ্য। কদর কমলেও ধুলোয় মিশবে না। যাক, এখন চলো। অনেক রাত হয়েছে, আর না খেয়ে থেকো না। আমি খাবার গরম করি, তোমরা এসো।”
–” সেই ভালো। তুমিও খাবে। আমি নিজে অপুকে খাইয়ে দেব।” অপুর গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল মাণিক, –” আফসোস একটাই। মাটির পুতুলের মত ওর গায়ে এই মারের দাগগুলো যদি মিলিয়ে দিতে পারতাম!”
সেই রাতে বাসি ভাত আর বেগুনের ঝোলটা একটু বেশি সুস্বাদু ছিল।
কিন্তু বাবার কথা থেকে অপু কি বুঝেছিল কে জানে যার জন্য আজ সে সকাল থেকে খুব ব্যস্ত। অবশ্য এটাই এখন ওর রুটিন।
–” অপুদা ও অপুদা।”
মাণিকের কাঁচা বাড়ি পাকা হয়েছে। ওর কাজের ঘরে এখন আশপাশের দু’দশ জন মৃৎশিল্পী নিয়মিত কাজ করে। সেখান থেকেই চিৎকার করল অপু, –” কে নবীন? ভেতরে আয়।”
হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলো নবীন, –” অপুদা, দারুণ খবর আছে একটা। গেল মাসে তেহট্টের মেলায় আমাদের স্টলে বাচস্পতি এসে ছিল না, আরে সেই স্থানীয় উঠতি নেতা, মনে আছে! সকালে ফোন করে বলল ওর চেনাজানা কলকাতার এক নামি পূজো কমিটি এবার থিম করবে টেরাকোটা। আমরা যদি মাটির জিনিস ওদের বরাত নিই, মোটা টাকা আসবে অপুদা। কি বলো, রাজি হবো?”
অপুর চোখ ভারী হয়ে এলো। ও তো এটাই চায়, ওদের মতো শিল্পীর কাজ পৌঁছে যাক বিশ্বের দরবারে। সেই কবে শুধু মাত্র চোখে দেখে হাতি বানিয়ে ছিল। তারপর এতগুলো বছর ঐ কাজ নিয়ে থেকেছে। মাটির জিনিস বানিয়ে বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করেছে সেগুলোকে, পৌঁছে দিয়েছে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। মাণিক বা নীলা কেউই নেই। তবে মাণিকের কাজের ধরন রপ্ত করে সেগুলো অবিরত শিখিয়ে চলেছে অপু অনেক অনেক মানুষকে। এভাবেই মাণিক বেঁচে থাকবে আরো অনেক বছর। খুশি হয়ে অপু নবীনকে সম্মতি দিল। খুব ইচ্ছে নিজে হাতে মা বাবার মূর্তি বানায়। এবার হয়তো সময় হলো এই কাজ করার কারণ স্রষ্টাকে বাদ দিয়ে শিল্প যে অসম্ভব।