চট্টগ্রামের পথে : কবিতা, স্মৃতি ও অনুভব
আজকের দিনটি আমার জীবনের পাতায় স্মরণীয় হয়ে রইল—কবিতার পথে হেঁটে চলা এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা। চট্টগ্রামের বুকজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা স্মৃতি, মানুষ আর ভাষার আলোয় আলোকিত হল আমার অন্তর্গত জগৎ।
আমি—জালাল উদ্দীন আহমদ—দুপুর একটায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রওনা দিই নিউমার্কেটের উদ্দেশ্যে। যাত্রা যতটা বাহ্যিক ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল অন্তরের। বাসের জানালায় চোখ রেখে দেখতে থাকি পাহাড়ের ছায়া, সমুদ্রের ইঙ্গিত, মানুষের মুখাবয়বে জেগে থাকা চট্টগ্রামের আত্মা।
নিউমার্কেটে এসে অপেক্ষা করতে না করতেই এলেন কবি সুপ্রিয় কুমার বড়ুয়া। সুপ্রিয়দা—কবিতা তাঁর শিরায়, শহরটা যেন তাঁর শ্বাসে। তারপর এলেন বেলাল চৌধুরী—কবিতা প্রেমিক, এক নির্লিপ্ত অথচ সংবেদনশীল সহচর। সবশেষে এলেন কবি নজরুল ইসলাম—নতুন সময়ের ভাষার ধারক। আমাদের চতুষ্টয় যেন ভিন্ন ধারার, কিন্তু একক অনুভবের।
আমরা ঘুরেছি শহরের প্রাণকেন্দ্র থেকে প্রাণের কেন্দ্রগুলোয়—
ডাঃ খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়—এই বিদ্যালয়ের একেকটা দেয়াল যেন কথা বলে। এখানেই ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন আমার একমাত্র পুত্র সন্তানের মা, সহকারী অধ্যাপক কামরুন নেছা। তাঁর প্রিয় শৈশবের পা-ফেলা স্থান! সেই দেয়ালের ছায়ায় দাঁড়িয়ে অনুভব করছিলাম এক গভীর সংযোগ—নানা সময়, নানা সম্পর্ক এক বিন্দুতে এসে মিলে যাচ্ছে।
তার পাশেই চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ—যেখানে থেকে এইচএসসি পাশ করেছিলেন কামরুন। তাঁর পিতা অধ্যাপক আব্দুস সালাম ছিলেন এই কলেজেরই গুণী শিক্ষক ও পরবর্তী অধ্যক্ষ। সরকারি কোয়ার্টারে তাঁদের থাকা, শহরের অলিগলি, বইয়ের গন্ধ—সব যেন স্পষ্ট হয়ে উঠছিল আজকের আলো-ছায়ায়।
আমরা হেঁটে গিয়েছিলাম ডিসি হিল-এ—চট্টগ্রামের বুকজুড়ে পাহাড়ের ঢেউ, বাতাসে ভেসে বেড়ানো শালিকের ডাক। সুপ্রিয়দার কণ্ঠে ছন্দ, বেলালের চোখে বিস্ময়, আর নজরুলের হালকা চুপচাপ হাসি—সব মিলিয়ে যেন পেছনে ফেলে আসা ছাত্রজীবনের বুনোট।
তারপর আমরা ঢুঁ মারি বাতিঘর-এ—একটি বইয়ের ঘর, যেখানে সময় থেমে যায় পাতার মলাটে। আমরা প্রত্যেকে কিছু বই হাতে নিই, পাতার গন্ধ নিই, চুপচাপ থাকি... যেন কবিতার ভেতরে ঢুকে পড়ি।
বৌদ্ধ মন্দির, খ্রিস্টান গীর্জা—দুটি ধর্মের দুটি পবিত্র স্থানেও গিয়েছিলাম। কেবল ধর্ম নয়, মানুষ ও সময়ের মেলবন্ধন দেখতে চেয়েছিলাম সেখানে। শান্ত প্রার্থনা, ধূপের গন্ধ, রঙিন কাঁচের জানালায় সূর্যালোকের খেলা—সব মিলিয়ে এক ধ্যানমগ্নতা।
সবশেষে গিয়েছিলাম লালদিঘি—প্রাচীন ও আধুনিক চট্টগ্রামের সাক্ষাৎ মিলনস্থল। দীঘির জল, চারপাশের বৃক্ষরাজি, হাঁটতে থাকা মানুষ, শীতল বাতাস—সেই পরিবেশে আমাদের কথা কমে আসছিল, কেবল অনুভব বাড়ছিল।
দিনভর টুকিটাকি খাওয়া-দাওয়া হয়েছে, চা-এর কাপ বদলেছে বহুবার। কিন্তু সবচেয়ে বেশি বদলেছে মন—আরো কোমল হয়েছে, আরও স্মৃতিমেদুর।
বিদায়ের মুহূর্তে আমি থেমে যাই। অনেক কথা বলতে চেয়েও পারিনি। কণ্ঠে এসে গিয়েছিল স্তব্ধতা। হয়তো কোনো কোনো অনুভব ভাষা চায় না। একটানা তাকিয়ে ছিলাম দূরের পাহাড়ের দিকে—যেখানে হয়তো আরেকবার দেখা হবে, কিংবা হবে না—তবু সেই দেখা আজকের দিনে থেকে যাবে চিরন্তন এক কবিতার মতো।
---