গল্প - রহস্যময়ী
কলমে -- মহুয়া মিত্র
নন্দীপুর স্টেশনে নামতেই আনন্দর গা ছমছম করে উঠলো। আজন্ম কলকাতার বাসিন্দাকে নামিয়েই ট্রেনটা পড়ি কি মরি করে ছুটল। আনন্দ চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলো কি ভীষণ ছোট্ট একটা স্টেশন। কোনো দোকানপাট তো দূরের কথা, এক কোণে ঝাপসা অফিস আর টিকিট কাউন্টার অবধি বন্ধ। এদিকে ঘড়ির কাঁটা রাত সাড়ে এগারোটা ছুঁই ছুঁই। আজ মনে হয় অমাবস্যা, নইলে এত অন্ধকার হয়! একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার যে! মনে মনে অহেতুক সাহস সঞ্চয় করে বাইরের দিকে এগোলো আনন্দ। শীতখানাও পড়েছে জাঁকিয়ে।
স্টেশনের বাইরে এসে আনন্দ দেখলো জায়গাটা বাজার মতন। ততক্ষণে অন্ধকারে চোখ সয়ে গেছে। সব দোকান বন্ধ। কোথাও কোন আলোর চিহ্ন মাত্র নেই। তাহলে তরুণদা যে বলেছিল হদ্দ গ্ৰাম হলেও নন্দীপুরে বিজলী বাতি আছে। তবে কি লোডশেডিং! কি জানি বাবা, কিন্তু এখন এতসব ভাবার সময় কই? যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তরুণদার বাড়ি পৌঁছাতে হবে। সেই বাড়ি আবার গ্ৰামের একটেরে। এদিকে অটো, টোটো, রিকশা বা ভ্যান সবই অমিল। যাবে কিভাবে? যা ঠান্ডা, একেবারে জমে যাওয়ার উপক্রম।
কি করবে ভেবে যখন কুলকিনারা পাচ্ছে না, এমন সময় হঠাৎ একটা গলার আওয়াজে পিলে চমকে যাওয়ার জোগাড়, --" আপনি আনন্দ বাবু আজ্ঞে?" পিছনে ফিরে আনন্দ দেখল একজন ছোটখাটো চেহারার মানুষ, আপাদমস্তক শীত পোশাকে ঢাকা, মুখে গ্ৰাম্য ছাপ, হাতে একটা লন্ঠন ধরা। কোনো মতে ঢোক গিলে আনন্দ বলল, --" হ্যাঁ। আপনি?" --" আমাকে বাবু আপনি আজ্ঞে করবেন না। আমি হরিচরণ, তরুণবাবুর বাড়ি দেখাশোনা করি। উনি সকালে ফোন করে বলেছিলেন আপনার কথা। কিন্তু আপনার তো বাবু বিকেলের ট্রেনে আসার কথা?"--" আর বোলো না হরিচরণ, শেষ মুহূর্তে একটা কাজে আটকে গেলাম। তাই শেষ ট্রেন ধরতে হলো।" --" আচ্ছা বাবু, চলেন।" বলে হরিচরণ আনন্দের ব্যাগটা নিতে গেলে আনন্দ বাঁধা দিয়ে বলল, --" শুনেছি বাড়িটা দূর আছে। আমরা যাবো কি করে?"--" আজ্ঞে বাবু, এত রাতে তো কিছুই পাবেন না। যা শীত, ভাড়া বেশি দিলেও ব্যাটারা আসবে না। তবে বাবু, চিন্তা নেই। আমার ভাইয়ের একটা ভ্যান আছে, ওটা এনেছি। আরামেই যাবেন।"
পথের দুই দিকে ঘরবাড়ি সব অন্ধকারে ডোবা। কনকনে শীত। কিছুটা চুপচাপ চলার পর আনন্দ বলল, --" লোডশেডিং না কি হরিচরণ?"--" আর বলেন কেন বাবু। এই নন্দীপুরে বিজলী বাতি হলো ক্ষণিকের অতিথি। তবে শীতকাল, অসুবিধা হবে না। " পথেই মোবাইলটা দুর্বল হয়ে পড়ে ছিল, ওটা যে এবার দেহ রাখবে সে বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে আনন্দ বলল, --" আচ্ছা হরিচরণ, এই ট্রেন থেকে আমি একাই নামলাম যে?"--" আর কে নামবে বলুন বাবু? এইটুকু গ্ৰাম। কে আর কোথায় যায়? যাও বা যায় সব ঐ বিকেল বিকেল চলে আসে। আপনাকে তখন না পেয়ে ভাবলাম যদি এখন আসেন। তাই আসা।" বলতে বলতে হরিচরণ একটা পাঁচিল ঘেরা ছোট্ট বাগান বাড়িতে থামলো। অন্ধকারে যদিও সেভাবে ঠাহর হয় না, তবু আনন্দের মনে হলো গোটা গ্ৰামে এটাই একমাত্র পাকা বাড়ি।
বেশ সুন্দর গোছানো ছোট্ট একতলা বাড়ি। লন্ঠনের আলোয় হরিচরণের করে দেওয়া গরম জলে পরিষ্কার হয়ে, গরমাগরম ভাত ও ডিমের ডালনা দিয়ে পেট ভরে খেয়ে, কম্বলের নিচে ঢুকতেই ঘুমের জগতে। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আগে গ্ৰামে খানিকটা হেঁটে এলো আনন্দ। খুব সুন্দর জায়গা। বাড়ি ফিরে সবে চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছে, দুজন প্রবীণ মানুষের আবির্ভাব। বোঝাই যাচ্ছে এখানকার বাসিন্দা। ওনাদের দেখে হরিচরণ বলে উঠলো, --" আরে, আসুন বাবুরা আসুন। ও বাবু, ওনারা হলেন নেপালবাবু আর জগতবাবু। এই গ্ৰামের মা বাপ। ওনাদের কথাই শেষ কথা। আপনারা বসুন, আমি চা নিয়ে আসি।"
আনন্দ নমস্কার করে বলল, --" বসুন আপনারা। এক্ষুনি গ্ৰামটা ঘুরে এলাম। খুব সুন্দর।"
নেপালবাবু বললেন, --" হরির কাছে শুনলাম আপনি এখানে ক'দিন থাকবেন। তা মশাই এত জায়গা থাকতে খামোখা এখানে কেন? কি আছে এখানে? তাছাড়া এখানে কেউ ঘুরতে আসে বলে কস্মিনকালেও শুনিনি।"
একটু হেসে আনন্দ বলল, --" দরিদ্র পরিবারের ছেলে আমি। নুন আনতে পান্তা ফুরোয় আর কি। একটা ছোটখাটো মুদির দোকান চালাই। মা বাবা ভাই আর স্ত্রীকে নিয়ে মোটামুটি চলছিলাম। কিন্তু বছর খানেক আগে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে স্ত্রীর মৃত্যু হলো। বাচ্ছাটাও ঘন্টা দুয়েক পর মায়া ত্যাগ করে। এরপর দুম করে বাবা চলে গেল হার্টফেল করে। মা মানসিক ভাবে এত ভেঙে পড়লো যে অনেক দূরে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করতে হলো। ভাইও বাড়ি থেকে চলে গেল কলেজ মেসে। দমবন্ধ অবস্থা। তরুণদা মানে এই বাড়ির মালিক আমার দোকানের খদ্দের। সেই বললে কটা দিন কোথাও থেকে ঘুরে আসতে। কিন্তু যাবো কোথায়? পকেট তো লঝঝরে। কথাটা অবশ্য মনে ধরলো। খুলে বলতে তরুণদাই এখানে আসতে বলে। তরুণদার পৈতৃক বাড়ি হলেও ওরা কেউ আসে না। যদিও হরিচরণের দৌলতে বাড়ির অবস্থা চমৎকার। "
জগতবাবু বললেন, --" সে থাকুন মশাই তবে খুব সাবধানে। বনে জঙ্গলে যাবেন না আর রাতে ঘুণাক্ষরেও দরজা জানালা খুলে শোবেন না। হরি অবশ্য সব জানে।"--" কেন বলুন দেখি? সাপ? কিন্তু শীতে সাপ আসবে কি করে?" হরিচরণ চা নিয়ে এলো, --" না বাবু, সাপ নয়। পোকা। কাল বলতে ভুলে গেছি।"--" পোকা?" চায়ে চুমুক দিয়ে জগতবাবু বললেন, --" হুম, পোকা। কি পোকা কেউ জানে না। কেমন দেখতে তাও না। শুধু জানে ঐ পোকা কামড়ালে শরীর অবশ হয়ে ধুম জ্বর আসে আর রোগী এক রাতের বেশী টেকে না। "--" কবে থেকে হচ্ছে এসব? তরুণদা জানে?"--" না বোধহয়। সে কি এই গ্ৰামে আসে যে জানবে, এক যদি হরি বলে থাকে।"--" না বাবু, আমি ওনাকে কিছু বলি নি। আর ঘটনাটা ঘটছেই তো মাস দুই তিন।"--" রোগীর চিকিৎসা হয় নি?" নেপালবাবু বললেন, --" হয়েছে। গ্ৰামের হাসপাতালে হয়েছে। চল্লিশ কিলোমিটার উজিয়ে শহরের হাসপাতালে হয়েছে। ওষুধ, ইনজেকশন, স্যালাইন সব হয়েছে। তাও পরপর ছ'ছটা মৃত্যু। আমরা বড়ো ভয়ে আছি মশাই।" জগতবাবু বললেন, --" আপনি আমাদের অতিথি। তাই সাবধানে থাকতে বলছি। বেশি বাইরে যাবেন না। ঘরেই থাকুন, বিশ্রাম নিন। কিছু লাগলে হরি তো রয়েছেই।"--" ঠিক বলেছেন বাবু। গত রাতে আনন্দবাবুকে কথাটা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। আমি ওনাকে সাবধানে রাখবো।"--" সেই ভালো। আমরাও সাবধানে চলছি। বেশ, আমরা উঠি তাহলে।"
এরপর মোটামুটি দিন দুই ভালো ভাবে কাটলো। ঘরে থেকে বিশ্রাম আর হরিচরণের হাতে ভালো মন্দ খেয়ে আনন্দের মন তরতাজা হয়ে উঠেছে। তরুণদা আর ভাইয়ের সঙ্গে নিয়মিত কথা হয়। ভাগ্যিস টেলিফোন ছিল, না হলে লোডশেডিংয়ের কল্যাণে মোবাইল মৃতবৎ।
সেদিন সকাল থেকে আচমকা বৃষ্টি এলো। দুপুরে খেয়ে উঠে জানলা দিয়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে গেছিল আনন্দ। যখন ঘুম ভাঙলো তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। গায়ে ধুম জ্বর।
হরিচরণ এসে ওর অবস্থা দেখে মাথায় খানিক জলপট্টি দিল। এত তাপে তাতে অবশ্য বিন্দুমাত্র আরাম হলো না। মাথা অসহ্য যন্ত্রণা।এরপরের সময়টুকু কিভাবে কাটলো আনন্দ জানে না। শরীর অবশ, চেতনাহীন।
তখন কত রাত কে জানে। অনেক কষ্ট করে চোখ মেললো আনন্দ। ঘরে টিমটিম করে মোমবাতি জ্বলছে। দরজা জানালা সব বন্ধ সত্ত্বেও কনকনে শীত। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। আনন্দ অনুভব করলো শরীরের তাপমাত্রা কিছুটা কম হলেও মাথায় ব্যথাটা রয়েছে। গলা বুক শুকিয়ে গেছে। একটু জল পেলে ভালো হতো। ডাকবে হরিচরণকে? সে কোথায় কে জানে? যদিও ডাকলেও গলা দিয়ে আওয়াজ বের হবে না। ঘরে একটা জলের কুঁজো আছে বটে! কিন্তু উঠে বসার ক্ষমতা নেই যে! শরীর কেমন ভারী হয়ে উঠেছে। চোখ বুজে শুয়ে রইলো আনন্দ। খুব ক্লান্ত লাগছে ওর।
আন্দাজ মিনিট তিন কি চার, হঠাৎ কপালে একটা শীতল কোমল হাতের ছোঁয়া পেয়ে চমকে চোখ মেললো আনন্দ। ঘরে এক ফোঁটা হাওয়া নেই অথচ মোমবাতির শিখা দপদপ করছে। খুব সুন্দর একটা গন্ধ ভাসছে আর আনন্দর চোখের সামনে স্পষ্ট এক নারী মূর্তি। রমণীর বয়স কুড়ি বাইশ মতো। সিঁথিতে চওড়া সিঁদুর, এলোচুলে কপালে লাল টিপ, হাতে শাঁখা পলা, পরনে লাল রঙের শাড়ি গ্ৰাম্য মেয়েদের ঢঙে পরা। অপূর্ব সুন্দরী, মুখে মমতা মাখানো হাসি। আনন্দ অবাক হয়ে চেয়ে আছে। রমণী ওর চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, --" কি হয়েছে বাবা, জল খাবি? দাঁড়া , আমি তোকে জল দিচ্ছি।" বলে চোখের নিমেষে এক গ্লাস জল এনে আনন্দর মুখে দিল। শীতল সুমিষ্ট সেই জল পান করে আনন্দের উত্তপ্ত শরীর জুড়িয়ে গেল। খুব আরাম লাগছে। ফের সেই রমণী আনন্দর কপালে হাত রেখে বলল, --" চিন্তা করিস না বাবা। সব ঠিক হয়ে যাবে। তুই ঘুমা, আমি তো আছি।" ভারি চমৎকার কন্ঠ। আনন্দর চোখে রাজ্যের ঘুম নেমে এলো।
চোখে আলো লাগতে অনেক কষ্ট করে চোখ খুললো আনন্দ। ঘরের সব দরজা জানালা খোলা। এখন আর বৃষ্টি নেই। নরম রোদ খেলা করছে ঘর জুড়ে। শরীরের মধ্যে সামান্য অস্বস্তিটুকুও নেই। কাল অত জ্বর ছিল, তার লেশমাত্র নেই আজ। শুধু দুর্বল লাগছে খানিক। সাবধানে উঠে বসলো। আর তখনই দেখল ঘরে হরিচরণকে সঙ্গে নেপালবাবু, জগতবাবু ও গ্ৰামের জনা কয়েক জন। ওকে দেখে হরিচরণ বললে, --" এখন কেমন বোধ করছেন বাবু? আমরা তো সবাই ভাবলাম আপনার দিন শেষ। এই রোগ থেকে কেউ বেঁচে ফেরে নি যে। আপনিই প্রথম। " নেপালবাবু বললেন, --" ঐ দুর্যোগে আপনাকে ডাক্তার বদ্যি করানো যেতো না, তাছাড়া করবেই বা কে? সবার প্রাণে ভয় আছে। তাই ঐ সামান্য জলপট্টি দিয়ে আপনাকে এই ঘরে রেখে হরিচরণ বাড়ি তালা দিয়ে আমার কাছে চলে যায়। সারাটা রাত আপনি একলাই ছিলেন। এ রোগে রুগী অচেতন থেকে সোজা মৃত্যু বরণ করে, তাই ও ভেবেছিল আর আপনার কিছু দরকার নেই। তারপর সারা রাত জেগে আপনার দাহকার্য বিষয়ে আলোচনা হয়। আপনার বাড়িতে খবর দিতে হবে তো! ঠিক হয় সকালে তরুণকে ফোনে সব বলা হবে। ভোরবেলা ওই গ্ৰাম থেকে লোকজন ডেকে আনে। এসে দেখে আপনার শ্বাস চলছে, জ্বর নেই। তাজ্জব ব্যাপার মশাই। কি করে কি হলো কে জানে।" জগতবাবু বললেন, --" সবটাই মা বিশালাক্ষীর কৃপা হে। গত রাতে পাশের গ্ৰামে খুব ধুমধাম করে মায়ের পূজো হয়েছে যাতে এই মড়ক এখান থেকে ওখানে না পৌঁছায়। আর দেখো মায়ের মহিমা! আনন্দবাবু দিব্য আছেন। জয় মা বিশালাক্ষীর জয়।"
কিন্তু আনন্দর চোখে তখন ভাসছে সেই রমণী যে তালা বন্ধ বাড়ি ঢুকে ওর সেবা করেছে। কে ছিল সে? সত্যিই কি দৈবী মাহাত্ম্য না কি জ্বরের ঘোর? ও জানে এই জবাব কেউ দিতে পারবে না। সেই অপরিচিতা আড়ালেই থেকে যাবে চিরকাল। কিন্তু সে যেই হোক, এমন ব্যাধি থেকে সকলকে রক্ষা করুক এই কামনা করল মনে মনে। তারপর ঠিক করলো আর এখানে নয়, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কলকাতা ফিরবে। কারণ কিছু কারণ হয়তো জন্মায়ই অন্তরালে থাকার জন্য।