1. info@dainiknetrojolsahitthomagazine.com : দৈনিক নেত্রজল সাহিত্য ম্যাগাজিন : দৈনিক নেত্রজল সাহিত্য ম্যাগাজিন
  2. info@www.dainiknetrojolsahitthomagazine.com : দৈনিক নেত্রজল সাহিত্য ম্যাগাজিন :
শনিবার, ১৯ জুলাই ২০২৫, ০২:৩৬ পূর্বাহ্ন

গল্প – বাস্তুভিটে কলমে – মহুয়া মিত্র কলকাতা ভারত

  • প্রকাশিত: শনিবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২৪
  • ১৪৫ বার পড়া হয়েছে

গল্প – বাস্তুভিটে
কলমে – মহুয়া মিত্র
কলকাতা
ভারত

বিরানব্বই বছরের মায়ের মধ্যে যেন সেই কবেকার অদেখা নয় বছরের বালিকাকে দেখতে পেলেন বিভূতি বাবু । তার মনে হলো এক্ষুনি বুঝি যে তার মা , বকুললতা , উঠে দাঁড়িয়ে দুই বিনুনি দুলিয়ে, লাল ডুরে শাড়ি পরে দৌড়ে বেরাবেন । গত আট বছর ধরে যে মানুষটা ভয়ানক মারণ ব্যাধিতে চারপাশের দুনিয়া ভুলে গিয়ে নিস্তেজ হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকেন, নড়ন ক্ষমতা নেই বললেই চলে , কাছের মানুষ চিনতে পারেন না, সেই মানুষ আজ জড়িয়ে জড়িয়ে অনর্গল কথা বলে চলেছেন । অথচ সপ্তাহ খানেক আগে যখন সেদিন সন্ধ্যা বেলা তীব্র শ্বাসকষ্ট শুরু হল তখন ডাক্তার বললেন, — ” বিভূতি বাবু , মনকে শক্ত করুন , আর খুব বেশি হলে দিন সাতেক । ”

রাত গভীর হলে যখন চারদিক নিস্তব্ধ হল , মায়ের পাশে এসে বসে বকুললতার কঙ্কাল সার হাতে হাত রাখলেন তার প্রিয় প্রথম সন্তান । বড্ড কাহিল আজ মা ছেলে দুজনেই । কড়া ওষুধের প্রভাবে অঘোরে ঘুমাচ্ছেন মৃত্যু পথযাত্রী । ঈষৎ খোলা মুখ থেকে ক্ষীণ শব্দ আসছে ।

হঠাৎই নড়ে উঠলেন বকুললতা, খুব আস্তে জড়ানো স্বরে বললেন, — ” বিভূ , আমাকে একটি বার কেয়াতলা নিয়ে যাবি , খুব যেতে ইচ্ছে করছে । ”

ক্ষণিকের অতিথি মায়ের শেষ ইচ্ছে পূরণের জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেন বিভূতি বাবু । ঐ রাতেই অ্যাম্বুলেন্স , স্ট্রেচার , হুইল চেয়ার, স্বাস্থ্য কর্মী, দরকারি কাগজ গোছানো সব, সব সেরে নিলেন । পাসপোর্ট ছিল, তড়িঘড়ি পরদিন ভোর হতেই এজেন্ট ধরে ভিসার আবেদন করলেন। তারপর শুধু ঈশ্বরকে স্মরণ। দিন পাঁচেক পর ভোর হতেই মৃতপ্রায় মাকে নিয়ে রওনা হলেন কেয়াতলার উদ্দেশ্যে । ধর্মনগরের বাড়ি থেকে আগরতলা হয়ে আখাউড়া বর্ডার পেরিয়ে বাংলাদেশ পৌঁছে মায়ের জন্ম ভূমি কুমিল্লার কেয়াতলা যখন পৌঁছলেন তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে । সেই কবেকার কেয়াতলা আজ আর যদিও জোনাক জ্বলা গ্রাম নেই, রীতিমত শহর তবুও যেখানে বকুললতার পিতৃগৃহ ছিল সেটা অনায়াসে খুঁজে পেলেন বিভূতি বাবু ।

বছর তিরিশ আগেও এখানে মানুষের বসবাস ছিল । বিভূতিবাবু নিজে বার দুই তিন মায়ের সাথে এসে ছিলেন । গোটা গ্রামের মধ্যে বকুললতার পিতৃগৃহ ছিল সবচেয়ে ধনী পরিবার । কারুকার্য করা প্রাচীর ঘেরা বিরাট অঞ্চল জুড়ে ছিল দালান কোঠা । কত মানুষ, কত রোশনাই, কত কথা, কত উৎসব, অনুষ্ঠান আজ ভগ্ন স্তূপ । ভেঙে পড়া ইমারতে সংসার পেতেছে বট , অশ্বত্থ, পিপুল । শ্বেত পাথরের ফোয়ারা সমৃদ্ধ বাহারি বাগানে আজ জংলী সাজ । কে যে কোথায় আছে, কে জানে! তবু এটা এককালে বকুললতার বাপের বাড়ি ছিল । তার জন্ম , বেড়ে ওঠা, বিয়ে সব এখানে হয়েছে ।

অত্যন্ত সাবধানে মৃত্যু পথযাত্রী বকুললতাকে যখন অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে হুইল চেয়ারে বসিয়ে বাড়ির চৌহদ্দিতে আনা হল তখন তার মুখে কষ্ট যন্ত্রণার লেশমাত্র নেই বরঞ্চ এক অদ্ভুত আলো খেলে বেড়াচ্ছে । যে মানুষটা অসুস্থতার কারণে পারিপার্শ্বিক সমস্ত কিছু ভুলে যাচ্ছে সেই এখন আপন মনে হেসে হেসে অনুচ্চারিত স্বরে বলে চলেছে কবেকার সব কথা ।

” জানিস বিভূ , ঐটা হল দক্ষিণ কোণ । ওখানে একটা বকুল ফুলের গাছ ছিল । সেবার বর্ষা কালে গাছ ভরে ফুল এল আর সেই বছরই আমার জন্ম । তাই তো আমার জেঠা মশাই আমার নাম রাখলেন বকুললতা । ”

” ঐখানে রথযাত্রার দিন দূর্গা মায়ের কাঠামো পূজো হত । আমি প্রতি বছর কাঠামো পূজোর জন্য নিজের হাতে মালা গাঁথতাম । ”

” এদিকে ছিল হরি মন্দির । দোলের সময়ে বিরাট উৎসব হত । কত লোক আসত । ”

” আর ঐ পিছনে ছিল খিড়কি পুকুর । সেখানে মাছ চাষ হত । কি স্বাদ সেই মাছের । যেদিন বড়ো মাছ ধরা হত সেদিন আমার বড়ো ঠাকুমা তার সম্বছরের নিরামিষ হেঁশেল ছেড়ে আমিষ রান্না ঘরে ঢুকে মাছ রাঁধত । ওহ্ , কি সোয়াদ । ”

” পুকুরের ধারে কেয়া ঝোপে দুটো শঙ্খচূড় থাকত । ঘোর গরমে আমরা মেয়েরা কাঁচা আম মেখে নির্জন দুপুরে ঐ পুকুর পাড়ে গাছের ছায়ায় বসে খেতাম আর গল্প করতাম । তখন কতদিন সাপ দুটোতে শঙ্খ লাগত । একদম আমাদের পাশে চলে আসত । কিন্তু কখনো কোন ক্ষতি করে নি । ”

” বাড়িতে ঢুকে ডান হাতে ছিল পিঠা ঘর । সারাটা শীত জুড়ে সেখানে ব্যস্ততার অন্ত ছিল না । বাড়ির গাছের নারকোল , গরুর দুধ, চাল গুড়ো এমনকি গুড় অবধি বাড়িতে তৈরি হত । আর কত রকমের পিঠে তার ইয়ত্তা নেই । ”

” ভিতর উঠোনের উল্টো দিকে ছিল ঠাকুরদাদার ঘর । ভীষন গম্ভীর মানুষ ছিলেন তিনি । সারা দিন সকলকে কড়া শাসনে রাখলেও সন্ধ্যা বেলা ওনার ঘরে বাড়ির মেয়ে বৌরা জমায়েত করত । উনি গল্প শোনাতেন । রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, ধর্ম কথা কত শত গল্প শুনে মন জুড়িয়ে যেত । ”

” আর ঠিক ওদিক পানে ছিল তুলসী মঞ্চ । তার সামনে হয়ে ছিল আমার বিয়ে । আমি তখন দশ আর উনি বাইশ । সেই যে ওনার সাথে ধর্মনগরের বাড়ি গেলাম, তারপর ওখানেই থেকে গেলাম । ”

” আর বাড়ির উল্টো দিকে ছিল রহমত চাচার বাড়ি । ওনার মেয়ে সাবিনা ছিল আমার সই । চাচার বাড়ি অনেক পোষা পায়রা ছিল । রোজ সকালে তাদের চাল খেতে দিতাম । ”

নাগাড়ে এত কথা বলে হাপাঁচ্ছেন বকুললতা, নিঃশ্বাস দ্রুত । ক্লান্তিতে চোখ বুজে মাথা হেলিয়ে দিলেন । একজন নার্স এসে বিভূতিবাবুকে বললেন, — ” এবারে ফেরা দরকার । খুব ধকল গেছে ওনার ওপর দিয়ে । বিশ্রাম চাই । ”

— ” সেই ভালো । ” বলে বিভূতিবাবু চেয়ে দেখলেন সন্ধ্যা নামছে বকুললতার অতীত স্মৃতিতে । ওনার বর্তমান ঝাপসা কিন্তু অতীত স্পষ্ট । হোক না সে বাস্তুভিটে প্রাক্তন কিন্তু সে যে বর্তমান অপেক্ষা অধিক । যতই মূল উপড়ানো হোক, শিকড়ের টান বকুললতাকেও ঠাঁইনাড়া হতে দেয় নি।

শেয়ার করুন

আরো পড়ুন
সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০৩১  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট