গল্প - ডালিয়া ফুলের চারা
কবি -- মহুয়া মিত্র
--" মা, মা ও মা!"
তুলির চিৎকারে বেশ বিরক্তই হলো সুপর্ণা। এমনিতেই শীতের বেলা। যত তাড়াতাড়িই কাজকর্ম শেষ করতে চাক, ঘড়ির কাঁটা সেই দুপুর দেড়টা দুটোর ঘরে। আজ তো অবস্থা আরও খারাপ। ইংরেজি নববর্ষ বলে কথা। ফরমায়েশি রান্না করতে করতে কখন যে বেলা কাবার, খেয়াল করে নি। স্নান খাওয়া সব বাকি। তার ওপর তুলি যে সকাল থেকে কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে কে জানে! এতক্ষণে সময় হলো তার ফেরার। নাওয়া খাওয়া ভুলে কি করছিল এত সময়? রান্নাঘর বন্ধ করে বসার ঘরে এসে মনটা ভালো হয়ে গেল সুপর্ণার। আট বছরের তুলির ছোট ছোট হাতে দুটো ডালিয়া ফুলের চারা, তাতে দুটো আধফোঁটা টকটকে লাল ডালিয়া। রাগ ভুলে মেয়ের কাছে গিয়ে বলল, --" কি সুন্দর রে। কোথায় পেলি?"
--" পরেশ দাদুর থেকে। জানো মা, দাদু আজ ভ্যানে করে কত্ত সুন্দর সুন্দর ফুলের চারা নিয়ে এসেছে। যে যা চাইছে তাকে তাই দিচ্ছে। আর একদম বিনামূল্যে। আমি এই দুটো আনলাম।"
--" সে কি! পরেশকাকা বিনামূল্যে গাছ দিচ্ছে? আচ্ছা ঠিক আছে, এবার চ, চান খাওয়া করবি। কত বেলা হলো সে খেয়াল আছে?"
--" কিন্তু মা, গাছ দুটো?"
--" বিকেলে বাগানে পুঁতে দেব'খন। এখন চল।"
সেদিন বিকেলে গাছ দুটো বাগানে বসানোর পর সুপর্ণার মনে হলো বাগানটা যেন আলো হয়ে গেছে। তুলিও খুব খুশি। হাততালি দিয়ে উঠলো, --" মা, আমি এবার থেকে রোজ গাছে জল দেব, গোড়ায় ঘাস হতে দেব না, শুকনো পাতা ফেলে দেব। তুমি যেভাবে আমাকে ভালবাসো, ঠিক সেভাবেই ভালোবাসব।"
সুপর্ণা মেয়েকে জড়িয়ে ধরলো।
পরদিন সকালে ছাদে জামাকাপড় মেলতে গিয়ে অবাক সুপর্ণা। পাশের বাড়ির ছাদে কত্তগুলো টব! ঐ বাড়ির মল্লিকাও তখন ছাদে। সুপর্ণা জিগ্যেস করল, --" কি ব্যাপার মল্লিকা, এত টব?"
মুচকি হেসে বলল মল্লিকা, --" তোমার ঘরে দুটো এসেছে আর আমার ঘরে কুড়িটা চারাগাছ এসেছে। তারই আয়োজন। তবে পরেশকাকুর গাছ বলেই ভরসা, ফুল ফুটবেই। সে বিনা পয়সায় হোক আর যাই হোক।"
সুপর্ণা একটু চিন্তিত হলো। পরেশকাকুর এই বিনামূল্যে গাছ দেওয়ার ব্যাপারে জানতে হচ্ছে।
দুই তিন দিন পর।
--" গাছ নেবে গো গাছ। ভালো ভালো ফুলের চারা, লেবু লঙ্কা বেগুনও আছে।"
পরেশের ডাক শুনে ছুটে উঠোনে বেরিয়ে এলো সুপর্ণা, --" পরেশকাকু, ও পরেশকাকু!"
গাছ ভর্তি ভ্যানখানা থামিয়ে হেসে বলল পরেশ, --" বলো বৌমা, কেমন আছো? তা সেই ধনে-পালং বীজ দিয়েছিলাম, হয়েছে?"
--" হয়েছে। আসলে আমি তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে ডাকলাম।"
--" বলো বৌমা কি কথা।"
--" তুমি বিনামূল্যে গাছের চারা দিয়েছো তুলিকে?"
বৃদ্ধ পরেশ এবার হেসে বলল, --" শুধু তুলিদিদি না, নববর্ষের দিন গোটা এলাকা জুড়ে চারা বিলিয়েছি। ভাবলাম নতুন বছরে সবাই কত কিছু করছে। আমি নয় গোটা এলাকা একটু ফুলে ফুলে সাজিয়ে দিই।"
--" খুব ভালো ভেবেছো তুমি।"
--" একলা মানুষ। তিন কুলে কেউ নেই। চারাগাছ বিক্রি করে একটা পেট দিব্যি চলে যায়। একদিন বিনামূল্যে দিলে কোনো অসুবিধা হবে না। এখন গাছ লাগানোর প্রবণতা কমছে। তবে সুন্দর ফুলের চারা দেখলাম সকলেই আগ্ৰহ ভরে নিল। আর অনেকে তো অর্ডার অবধি দিল। এবার অপেক্ষা ফুল ফুটে চারপাশ ঝলমল করার।"
হঠাৎ দমকা উত্তরে বাতাস এসে আশপাশ কাঁপিয়ে দিল। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দুলে উঠলো তুলির ডালিয়া ফুল দুটোও। এই ক'দিনে ফুল দুটো একটু বড়ো হয়েছে যে!